আহসানুর রহমান রাজীব: বাংলার ঘরে ঘরে ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে আত্মত্যাগের উৎসব। ঈদ উল আজহার মূল শিক্ষা পশু কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। কিন্তু কোরবানির পর যেভাবে রাস্তায় রক্ত, নাড়িভুঁড়ি আর দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে তাতে ঈদের আনন্দ যেন অসুস্থতা আর পরিবেশ দূষণের দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। বিশেষ করে সাতক্ষীরা শহর ও আশপাশের এলাকাগুলোতে কোরবানির দিন ও তার পরের কয়েকদিন এক ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। ড্রেনেজ বন্ধ, দুর্গন্ধ, মাছি-কুকুরের উপদ্রব আর সবচে’ ভয়ংকর জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি।
পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র:
গত বছর ঈদের দিন সাতক্ষীরা পৌর এলাকার মুনজিতপুর, কামালনগর, বাইপাস, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায় রাস্তার পাশে জবাই করা পশুর রক্ত জমে আছে, প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা নাড়িভুঁড়ি ড্রেনের পাশে ফেলা, কুকুর, বিড়াল, মাছির ভিড়ে দুর্গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকা দায়।
স্থানীয় এক দোকানি বলেন, “ঈদের তিন দিন দোকান খুলতে পারি না। দুর্গন্ধে কেউ আসে না। রাস্তার পাশে কোরবানি দিলে এরকম হবেই।”
স্বাস্থ্যঝুঁকি: চেপে রাখা বিপদ
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডাঃ মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, “কোরবানির বর্জ্য যদি দ্রুত এবং সঠিকভাবে অপসারণ না করা হয়, তাহলে টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ নানা ধরনের সংক্রামক রোগ ছড়াতে পারে। বিশেষ করে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।” তিনি আরও জানান, বায়ুবাহিত জীবাণুর মাধ্যমে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকাতেও এসব রোগ ছড়াতে পারে।
সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রশাসক মাশরুবা ফেরদৌস বলেন “আমরা ঈদে বর্জ্য অপসারণের জন্য বিশেষ টিম গঠন করছি। পৌর এলাকার ৯টি ওয়ার্ডে দ্রুত বর্জ্য সরিয়ে নিতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের শিফট ভিত্তিক দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে নাগরিকদের সচেতনতা ছাড়া এই কাজ সম্ভব না।” তিনি আরও যোগ করেন, “যে যার মতো খোলা জায়গায় কোরবানি দিচ্ছেন, তারপর নাড়িভুঁড়ি ফেলে যাচ্ছেন। এতে ড্রেনেজ সিস্টেম নষ্ট হয়, শহরের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়।”
সমস্যা কোথায়?
রাস্তা বা বাড়ির সামনেই পশু জবাই করা,
বর্জ্য ড্রেনে বা খোলা স্থানে ফেলা,
যথাসময়ে বর্জ্য অপসারণ না হওয়া,
নাগরিক দায়িত্বের ঘাটতি।
সমাধান কী হতে পারে? সহজ কিছু পরামর্শ
১. নির্ধারিত স্থানে কোরবানি দিন
পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্ধারিত কোরবানির স্থান তৈরি করে দেওয়া হয়। সেসব স্থানে কোরবানি দিলে বর্জ্য অপসারণ দ্রুত ও সঠিকভাবে হয়।
২. বর্জ্য পুঁতে ফেলুন
যদি নিজ বাড়িতে কোরবানি দেন, তবে নাড়িভুঁড়ি ও রক্ত মাটির নিচে পুঁতে ফেলুন। এতে দুর্গন্ধ ছড়ায় না, পরিবেশ দূষণও হয় না।
৩. ব্লিচিং পাউডার বা চুন ছিটান
বর্জ্য ফেলার পর জায়গায় ব্লিচিং পাউডার ছিটালে জীবাণু মরে যায়, দুর্গন্ধ কমে।
৪. প্লাস্টিক নয়, বন্ধ্যাযুক্ত ব্যাগ ব্যবহার করুন
বর্জ্য পলিথিনে না ফেলে পচনশীল ব্যাগে ভরে ফেলুন। এতে বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবেশ রক্ষায় সুবিধা হয়।
৫. নিজের চারপাশ নিজেই পরিষ্কার রাখুন
পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদকে দায় না দিয়ে নিজ দায়িত্বে বর্জ্য নির্ধারিত স্থানে ফেলুন, পাশে ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না।
পৌরসভার গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা
ঈদের দিনে পৌরসভার হটলাইন নম্বর চালু থাকবে – সেখানে কল করলেই বর্জ্য সংগ্রহ টিম পাঠানো হবে। নিজ ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গে আগেভাগে যোগাযোগ রাখুন। সামাজিকভাবে প্রতিবেশীদের সচেতন করুন। কেউ যদি খোলা জায়গায় বর্জ্য ফেলে, তাকে বাধা দিন।
ঈদ উল আজহা কেবল পশু জবাইয়ের উৎসব নয়, এটা ত্যাগ, শৃঙ্খলা আর পরিবেশ সচেতনতাও শেখায়। একটু সচেতন হলেই ঈদের খুশি সবাই ভাগ করে নিতে পারে সুস্থ ও নির্মল পরিবেশে। আসুন, পরিবেশবান্ধব কোরবানির মাধ্যমে আমরা গড়ি পরিচ্ছন্ন শহর, নিরাপদ স্বাস্থ্য।
