নিজস্ব প্রতিনিধি: ঘেরের পাড়ে অমৌসুমে তরমুজ ও সবজি চাষে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে। আগে যেসব জমি বছরের পর বছর অনাবাদি পড়ে থাকত, সেসব জমিই এখন পরিণত হচ্ছে সোনার খনিতে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) উপকেন্দ্র, সাতক্ষীরার তত্ত্বাবধানে এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) অর্থায়নে এই উদ্যোগ স্থানীয় কৃষকদের নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে।
সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা ইউনিয়নের বলাবুনিয়া গ্রামে এউপলক্ষ্যে মাঠ মূল্যায়ন ও প্রচারণা কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সার্ক কৃষি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (শস্য) ও পরিচালক ড. মো. হারুনূর রশীদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএআরসি’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জামাল উদ্দীন, বিনা উপকেন্দ্র সাতক্ষীরার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান ও মো. মিলন কবীর। সভাপতিত্ব করেন বিনা উপকেন্দ্র সাতক্ষীরার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রাতিষ্ঠানিক ফোকাল পয়েন্ট ড. মো. কামরুজ্জামান।
বক্তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, লবণাক্ততা আর অনুকূল আবহাওয়ার অভাবে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকরা নানা সমস্যায় ভুগছেন। তাই জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে ঘেরের পাড়কে কাজে লাগানো গেলে কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।
বলাবুনিয়া গ্রামের কৃষক দিপক মণ্ডল দীর্ঘদিন ধরে তার আট বিঘা ঘের অনাবাদি ফেলে রেখেছিলেন। বিনার মাঠ প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী দেখে তিনিও এগিয়ে আসেন। এবারই প্রথম তিনি তার ঘেরে তরমুজ চাষ শুরু করেন।
দিপক মণ্ডল বলেন, “আগে ভাবিনি ঘেরের জমিতে তরমুজ হবে। কিন্তু এখন দেখি খুব ভালো ফলন হচ্ছে। আড়াই মাসেই গাছে প্রচুর তরমুজ ধরেছে। প্রতিটি তরমুজের ওজন ৫ থেকে ৭ কেজি পর্যন্ত হচ্ছে। খরচও কম, লাভও অনেক বেশি।”
বিজ্ঞানিদের মতে, ঘেরের পাড়ে অমৌসুমী তরমুজ চাষ এখন সময়োপযোগী একটি উদ্যোগ। তরমুজ চাষে অন্যান্য ফসলের তুলনায় কম পরিশ্রম লাগে, রোগবালাই ও পোকার আক্রমণও কম হয়। মাত্র ৭০ দিনের মধ্যে বাজারজাত করা যায়, ফলে কৃষক দ্রুত আয় পান। হেক্টরপ্রতি ফলন হয় প্রায় ৪০ মেট্রিক টন।
ড. হারুনূর রশীদ বলেন, “আমরা চাই কৃষকেরা ঘেরের অনাবাদি জমি সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করুক। এতে যেমন কৃষকের আয় বাড়বে, তেমনি স্থানীয় বাজারে সবজি ও ফলের সরবরাহও বাড়বে।”
এবার শুধু তরমুজেই থেমে থাকেননি কৃষকেরা। প্রথমবারের মতো করলা, বরবটি, লাউসহ নানান সবজি চাষ শুরু করেছেন। গ্রামের অনেক পরিবারই এখন মাছের পাশাপাশি সবজি উৎপাদন করছে। ফলে একদিকে বাজারে চাহিদা পূরণ হচ্ছে, অন্যদিকে কৃষকদের আয়ও বহুগুণে বেড়েছে।
গ্রামবাসী রমেন বালা জানান, “আগে মাছের মৌসুম ছাড়া আমাদের হাতে কাজ থাকত না। এখন ঘেরের পাড়ে সবজি চাষ করে সারা বছরই বাড়তি আয় হচ্ছে।”
বিনা সাতক্ষীরার কর্মকর্তারা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন কিভাবে কীটনাশক কম ব্যবহার করে নিরাপদ উপায়ে সবজি উৎপাদন করা যায়। ফলে উৎপাদিত সবজি যেমন স্বাস্থ্যসম্মত হচ্ছে, তেমনি বাজারে এর চাহিদাও বাড়ছে।
বিনা উপকেন্দ্র সাতক্ষীরার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. কামরুজ্জামান বলেন, “এখানে আমরা প্রদর্শনীর মাধ্যমে কৃষকদের হাতে-কলমে শিখাচ্ছি। রোগ-পোকা নিয়ন্ত্রণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি জৈব পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি।”
স্থানীয়দের প্রত্যাশা, বলাবুনিয়া গ্রামে শুরু হওয়া এই কৃষি বিপ্লব একদিন গোটা সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। এতে শুধু কৃষকের আয় বাড়বে না, বরং স্থানীয় খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।
কৃষকরা মনে করছেন, ঘেরভিত্তিক মাছ ও সবজি চাষের এই সমন্বিত পদ্ধতি ভবিষ্যতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিকে নতুন গতি দেবে।
