বি.এম. জুলফিকার রায়হান ::
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় ন্যায্য অর্থায়ন ও কার্যকর অভিযোজন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভাগীয় পর্যায়ে জলবায়ু ও দুর্যোগ ঝুঁকি অর্থায়ন ও বীমা সম্পর্কিত পরামর্শ ও মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে খুলনার একটি তারকা হোটেলে অনুষ্ঠিত এই সভার মূল উদ্দেশ্য ছিল উপকূলীয় জীবন ও জীবিকায়, বিশেষ করে কৃষিতে, লবণাক্ততা, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মূল্যায়ন করা। এর ভিত্তিতে টেকসই উৎপাদনের জন্য অভিযোজন কৌশল এবং নীতিগত প্রস্তাবনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
সভায়, কোস্টাল কমিউনিটির জন্য স্থানীয় নেতৃত্বাধীন CDRFI (Multi-Actor Partnership on Climate and Disaster Risk Finance and Insurance) উদ্যোগ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা চিহ্নিত করে কার্যকর সমাধান প্রস্তাবনার বিষয়েও আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া, COP-30 এর প্রেক্ষাপটে ক্লাইমেট ফাইন্যান্সিং বিষয়ক এ্যাডভোকেসি ইস্যু নির্ধারণের বিষয়েও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সভাটি আয়োজিত হয় অ্যাওসেড ও কেয়ার বাংলাদেশ এর সহযোগিতায় এবং এটি বাস্তবায়িত হয় জার্মান ফেডারেল মন্ত্রণালয় (BMZ) এর অর্থায়নে MAP CDRFI প্রকল্পের অংশ হিসেবে।
প্রজ্ঞাপিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দুই দশকে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠ ৫০ সে.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে উপকূলীয় ১৭% জমি প্লাবিত হতে পারে, ৪০ হাজার হেক্টর মৎস্য প্রজননক্ষেত্র বিলীন হতে পারে, এবং দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের মিঠা পানির নদীর আয়তন ৪০.৮% থেকে ১৭.১%-এ নেমে আসতে পারে। এছাড়া লবণাক্ততা ২৬%-৫৫%-এ পৌঁছাতে পারে। উপকূলীয় অঞ্চল প্রায় ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ, যেখানে ১৯টি জেলা ও ৫০৯টি ইউনিয়ন অন্তর্ভুক্ত। এখানে বসবাসকারী জনসংখ্যা প্রায় ৪৪.৮ মিলিয়ন, যা মোট জনসংখ্যার ২৮%, এবং এই অঞ্চলের ১ কোটি ৫২ লাখ মানুষ বসতভিটা হারাতে পারে।
সভায় অ্যাওসেডের নির্বাহী পরিচালক শামীম আরফিন এর উপস্থাপনায়, প্রফেসর ড. মো: মুজিবর রহমান এর সভাপতিত্বে বক্তারা বলেন যে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা, পানির সংকট, জলাবদ্ধতা, ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার কারণে কৃষি ও জীবিকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু-সহনশীল ফসল এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যায্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সভায় উপস্থাপিত সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় প্রতিনিধি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ এড়ানো, জলবায়ু-সহনশীল ফসল প্রবর্তন, আশ্রয়কেন্দ্র ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন, এবং স্থানীয় জনগণের অভিজ্ঞতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা। এছাড়া TRM (Tidal River Management) বাস্তবায়ন, নদী ও খালের প্রাকৃতিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা, জমির লবণাক্ততা হ্রাস, ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি এবং মিঠা পানির সংরক্ষণ বিষয়েও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
সভায় আরও আলোচিত হয়েছে- তিন পক্ষীয় যৌথ উদ্যোগ (স্থানীয় জনগোষ্ঠী, বেসরকারি ও সরকারী সংস্থা) গ্রহণ, লবণ সহনশীল শস্যের প্রসার, পরিবেশ ও নারী বান্ধব আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্য সেবায় সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগ জোরদার করা। উপকূলীয় অভিযোজনে স্থানীয় পরিবেশ ও পানি কেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজন হলে বাঁধ নির্মাণ ও পানি ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও পুনর্গঠন করা হবে। এছাড়া শিক্ষাক্রমে দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্ষয়ক্ষতি বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সরকারী ভর্তুকি মূল্যে পূর্বাভাস ভিত্তিক দূর্যোগ ও শস্য বীমা প্রচলন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
সভায় উপস্থিত ছিলেন, খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার মো. আশরাফুল আলম, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. সাদিকুল ইসলাম, কৃষিবিদ মো. কামরুল ইসলাম, প্রফেসর ডা. দিলারা বেগম, প্রফেসর ইফাত সানিয়া ন্যান্সি, প্রফেসর এস এম এমরান হোসেন, কেয়ার বাংলাদেশের পলাশ মন্ডল ও মো. ফেরদৌস, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ হাসান মেহেদী, কেয়ার বাংলাদেশের পলাশ মন্ডল, আবদুল হালিম, আবুল হোসেন, সাংবাদিক মোস্তফা জামান পপলু, সাংবাদিক হেদায়েত হোসেন, সাংবাদিক শেখ আল এহসান, সাংবাদিক শরিফুল্লাহ কায়সার সুমন, সাংবাদিক কৌশিক দে বাপ্পী, সাংবাদিক আমিনা বিলকিস ময়না, সাংবাদিক এইচ এম আলাউদ্দিন, সাংবাদিক ইসরাত জাহান, সাংবাদিক জুলফিকার রায়হান, মাধব চন্দ্র দত্ত, হোসনেয়ারা বেগম, শেখ আবুল কালাম, মো. হানিফ খান, রেখা মারিয়া বৈরাগী, রিফাত জাহান উষা, শঙ্কর রঞ্জন সরকার ও শিরীনা পারভিন প্রমুখ।
সভায়- জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে সৃষ্ট দূর্যোগে ত্রান বা ঋন নয়, ক্ষতিপূরণ চাই; উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য আলাদা মন্ত্রনলায়/অধিদপ্তর চাই, সরকারী ভূর্তুকি মূল্যে, পূর্ভাভাস ভিত্তিক দূর্যোগ ও শষ্য বীমা প্রচলণ করতে হবে, সোস্যাল সেপ্টিনেটের আওতায় দুর্যোগ ও জলবায়ু ভাতার প্রচলণ করতে হবে, নদী রক্ষায় TRM প্রচলন, পানি ব্যবস্থাপনা, পোল্ডার, বাঁধ সংস্কার, উপকূলীয় বাজেট বরাদ্ধ বৃদ্ধি করতে হবে- এমন সব দাবি উত্থাপন করা হয়।
সভা শেষে বক্তারা আশা প্রকাশ করেন যে, আসন্ন COP-30 এ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কার্যকর এডভোকেসি ও ন্যায্য অর্থায়নের দাবি জোরদার হবে। এটি উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
